সমন্বিত জলাভূমি ব্যবস্থাপনা : একটি সিআইএফআরআই উদ্যোগ
গাইঘাটা, উত্তর ২৪ পরগনা : মৎস্যচাষীদের গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মতভাবে পেন কালচারের মাধ্যমে মাছ চাষে অধিক মুনাফার সন্ধান দিলো কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র (সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট) বা সিআইএফআরআই সংক্ষেপে সিফরি। শুক্রবার ডুমা ফিশারমেন কোঅপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত এশিয়ার বৃহত্তম অশ্বক্ষুরাকৃতি জলাভূমি ডুমা বাওড়ে পেন কালচারের জন্য বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ০.১ হেক্টর করে মোট ছয়টি ইউনিটের ০.৬ হেক্টরের পকেট জলাশয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
জলাভূমি তার পরিবেশগত পরিষেবার জন্য মানবজাতির কাছে এক অনন্য আশীর্বাদ। আইসিএআর – সিআইএফআরআই অর্থনৈতিক দুর্বল সম্প্রদায়ের জীবিকাকে উন্নত করার জন্য জলাভূমিতে মৎস্যচাষ উন্নয়নের দিকে ক্রমাগত কাজ করে চলেছে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার ডুমা জলাভূমিতে তপসিলি জাতি উপ-পরিকল্পনার অধীনে সমন্বিত উন্নয়ন পদ্ধতির সূচনা করা হয়েছে। ডাঃ বি কে দাস, পরিচালক, আইসিএআর – সিআইএফআরআই-এর লক্ষ্য ছিল তিন বছরের মধ্যে ১০০০ কেজি/হেক্টর/বছর পর্যন্ত মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
পেন কালচারের মূল উদ্দেশ্য হলো এর মাধ্যমে অধিক অর্থের সাশ্রয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় বড় জলাশয়ে কার্নিভোরাস মাছ বা মাংসাশী মাছ অর্থাৎ বোয়াল, কালবোস, মাগুর, শোল মাছেরা ছোট পোনা মাছকে সহজেই খেয়ে ফেলে। তাই যখন কোনও জলাশয়ে মাছ ছাড়া হয় তার প্রায় অধিকাংশ ছোট চারা মাছ কার্নিভোরাস মাছের খাদ্য হয়ে ওঠে। এর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ছোট-ছোট পকেট জলাশয়ে মাছকে আলাদাভাবে খাবার দিয়ে বড় করে তোলা হয়। এক্ষেত্রে ছোট মাছ দুই মাস বাদে ১৫ থেকে ২০ গ্রাম ওজনের হয় সেই সময় মাছগুলোকে মূল জলাশয় বা বাওড়ে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এরফলে একাধারে যেমন মাছের ফলন বৃদ্ধি পায় তেমনি কার্নিভোরাস মাছের থেকে ছোট মাছগুলোকে রক্ষা করা যায়।
ডুমা ফিশারমেন কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিঃ পরিচালিত ডুমা বাওড়ের আয়তন ২৫৭ হেক্টর, জলের গভীরতা ৮ থেকে ১৭ ফুট। এই সংস্থার মধ্যে ৩০ জন মহিলা সহ ১০৮১ জন মৎসজীবী সদস্য রয়েছেন। ডুমা জলাভূমির আশেপাশের ডুমা পঞ্চায়েত, ঝাউডাঙ্গা পঞ্চায়েত ও কালপুর পঞ্চায়েতের অধীন ৯টি গ্রামের মৎস্যজীবী পরিবার সম্পূর্ণরূপে এই জলাভূমির উপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। কলমে মাছ চাষের মাধ্যমে এই জলাভূমি থেকে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এইচডিপিই কলম, মাছের খাদ্য, রুই, কাতলা, মৃগেল মাছের বীজ, পুঁটি এবং গ্রাস কার্প বিতরণ করা হয়েছিল। একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই সহায়তার মাধ্যমে সমবায় সমিতি কলমে মাছগুলিকে চাষ করেছে এবং ৩৫-৪০ গ্রাম ওজনের পরে, কম বিনিয়োগে ভালো উৎপাদনের জন্য মাছগুলিকে জলাভূমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালে তারা ছোট দেশি মাছ ছাড়াও প্রায় ৩০ লাখ মূল্যের প্রায় ১৫ টন মাছ উৎপাদন করেছে। এই মাছ স্থানীয় বাজারে এবং মাছ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। এছাড়াও, নিয়মিত ভাবে ৫০০-রও বেশি সক্রিয় জেলে মৌরালা, পুঁটি, খয়রা, বেলে, পাঁকাল, ট্যাংরা, মাগুর, শিঙি, জিওল মাছ এবং অন্যান্য ছোট আকারের দেশীয় মাছ ১-২ কেজি প্রতিদিন ধরে।
বিগত বছরের ন্যায় এই বছরও ১৭ জুন ২০২২ একটি ‘পেন কালচার প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা শিবির’ পরিচালিত হয়েছিল। প্রায় ৭৮০ কেজি মাছের বীজ মজুদ করা হয়েছে। আগাছা যুক্ত জলাভূমি হওয়ায় এই জলাভূমিতে ‘গ্রাস কার্প মডেল’ও গ্রহণ করা হয়েছে। গণসচেতনতামূলক কর্মসূচিতে মৎস্যজীবীদের বিনিয়োগের খরচ কমাতে পেন কালচারের মাধ্যমে মাছের বীজের ইন-সিটু বৃদ্ধি সহ সমন্বিত জলাভূমি উন্নয়ন পদ্ধতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। মৎস্যজীবীদের জলাভূমিতে মৎস্যচাষের জন্য পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পেন কালচারের প্রদর্শন করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠান চলাকালীন আইসিএআর- সিআইএফআরআই এর ডিরেক্টর ডাঃ বি. কে. দাস মৎস্যজীবীদের আয়ের উন্নতি করতে এবং দেশীয় ছোট মৎস্য প্রজাতির সংরক্ষণের জন্য জলাভূমিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মজুদকৃত উচ্চমূল্যের মৎস্য উৎপাদন পদ্ধতি গ্রহণ করার পরামর্শ দেন। তিনি জৈবিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবে জলাভূমিতে নিমজ্জিত মাইক্রোফাইটগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য গ্রাস কার্প মজুদ করার পরামর্শ দেন। পরবর্তী বছরে মাছ ছাড়ার জন্য তাদের লভ্যাংশের ৫০% ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। সমন্বিত জলাভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত প্রধান সমস্যাগুলি মূল্যায়ন করার জন্য সচেতনতামূলক অংশগ্রহণমূলক গ্রামীণ মূল্যায়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল।
এদিনের অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের আধিকারিকরা ছাড়াও সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ভবিষ্যতে মৎস্য চাষের লাভজনক দিক আরো সমৃদ্ধশালী করার ইঙ্গিত দিচ্ছে।